Header Ads

বাংলা সুলতানী আমলে কেমন ছিল সোনারগাঁ? কেন আপনাকে সোনারগাঁও দেখতে হবে?


বাংলা সুলতানী আমলে কেমন ছিল সোনারগাঁ? কেন আপনাকে সোনারগাঁও  দেখতে হবে?

কেন এই লিখাটি আপনি পড়বেন? 

আপনি কি বাংলাদেশী বাঙালি নন ? আপনার কি গৌরব করার কিছুই নেই ? অবশ্যই আছে। নিজেকে গৌরবান্বিত করতে কালই নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁও হতে ঘুরে আসুন। গর্বে আপনার বুক ফুলে উঠবে 
এবং মন ভালো হয়ে যাবে। আজকের লিখাটি প্রাচীন বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওকে নিয়ে। কেন পড়বেন আজকের প্রবন্ধটি? পড়তে থাকুন, তাহলেই জানবেন।

সোনারগাঁওয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস 

আজকের প্রবন্ধটি পূর্ব বাংলার গৌরবগাথা ঐতিহাসিক সোনারগাঁওকে নিয়ে। সোনারগাঁও একটি প্রাচীন শহরের নাম যেটি প্রগৈতিহাসিক যুগ হতে বাংলার কতিপয় রাজা বাদশাদের রাজধানী ছিল। শুধু কি তাই? একসময়ে এই সোনারগাঁও পূর্ববঙ্গ ও দক্ষিণ এশিয়ার শিল্প সংস্কৃতির প্রতিনিধিত্ব করতো। ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে দিল্লির সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ঢাকা সুবে বাংলার রাজধানী হিসেবে ঘোষিত হবার পর ঐতিহাসিক সোনারগাঁওয়ের গুরুত্ব কমতে থাকে।



 কোন সময়ে সোনারগাঁওয়ের প্রসিদ্ধি সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়িয়েছিলো?
প্রাচীনকালে বাংলাদেশের সোনারগাঁও বঙ্গ, সমতট, সেন এবং দেব রাজবংশের একটি ঘাঁটি ছিল। প্রাচীনকালে এই সোনারগাঁও ছিল পূর্ব বাংলার প্রসিদ্ধ একটি নদী বন্দর, যে বন্দরের সাথে পুরো ভারত বর্ষ, সিলন, পেগু ও মালাক্কার ব্যবসাবাণিজ্য চালু ছিল। দিল্লি ও বাংলা সালতানাতের সময় সোনারগাঁও এর গুরুত্ব ও প্রসিদ্ধি এতো বেশি হয়েছিল যে বিভিন্ন দেশ হতে বিদেশিরা এই সোনারগাঁওয়ে অভিবাসী হয়ে ব্যবসা বাণিজ্য করতে এসেছিলো এসেছিলো যেরকম বর্তমানে বাংলাদেশিসহ তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষরা জীবিকার অন্নেষনে ইউরোপ-আমেরিকার উদ্দেশ্যে দেশত্যাগ করছে। সোনারগাঁয়ে রয়েছে সোনাবিবির মাজার, পাঁচ পীরের মাজার, গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি, ইব্রাহীম দানিশমান্দ-এর দরগা ইত্যাদি নানারকম স্থাপনা। আর পাশেই রয়েছে সে সময়ের উচ্চবিত্ত ধনি ব্যাবসায়ী বণিকদের বিলাসবহুল বাসস্থান যেটিকে পানাম নগরী বলে।
  

সোনারগাঁওয়ের প্রধান প্রধান আকর্ষণ 

আজকের প্রবন্ধটিতে আপনি দেখতে পাবেন ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের সন্নিকটে অবস্থিত বাংলার অন্যতম প্রাচীন রাজধানী ঐতিহাসিক সোনারগাঁওয়ের পানাম নগর , ঈসা খাঁর সদর বাড়ি এবং কারু শিল্প জাদুঘর। পানাম নগর দেখলে আপনি ভাবনার গাড়িতে চড়ে চলে যেতে পারবেন প্রাচীন কালের কোনো এক স্বপ্নের শহরে - যেখানে আপনার জন্য অপেক্ষা করছে অপরূপ সুন্দর এক নগরীর অলিগলিতে ছুটে চলা দুরন্ত ঘোড়ার গাড়ি, চুন-সুরকির সুরম্য অট্টালিকা, মসলিন কাপড়ের দক্ষ কারিগরদের সগৌরব কোলাহল, বন্দরে নোঙ্গর করা ধনী বণিকদের সুবিশাল জাহাজের সারেং-খালাসীদের ব্যাস্ত কর্মযজ্ঞের অনুভূতি।
সোনারগায়ে আপনাকে স্বাগত জানাবে মুঘল ও সুলতানি স্থাপত্য শৈলীর অনন্য মিশ্রণে নির্মিত পানাম নগরের দালান কোঠা, সুলতানি আমলের শিল্পকর্মের স্মারকস্থাপনা গোয়ালদী মসজিদ, ঈসা খাঁর সদর বাড়ি, সোনাবিবি ও পাঁচ-বিবির মাজার, মোগরাপাড়ায় সুফী সাধক ইব্রাহিম দানিশমান্দ এর কবরসহ তার গড়া ভারত বর্ষের অন্যতম সেরা বিদ্যাপীঠের স্মৃতি-চিহ্ন। পানাম নগরীর আধা মাইল উত্তর-পূর্বে রয়েছে গোয়ালদী মসজিদ - যেটি বাংলার সুলতান হোসেন শাহীর আমলে ১৫১৯ সালে তৈরী করা হয়েছিল। বাংলার সুলতানি আমলের আগে প্রাচীন যুগে ভ্যানগা (Vanga), বৌদ্ধ, সেন (Sena)
ও দেব (Deva) আমলে অনেক রাজা সম্রাটদের রাজধানী ছিল এই সোনারগাঁও।
এই সোনারগাঁও হতেই বাংলার স্বাধীন সুলতান ও বারো ভুঁইয়ারা মোঘলদের সাথে
কয়েকটি যুদ্ধের নেতৃত্ব দিয়েছিলো।


 সোনারগাঁয়ের নাম এলেই ঈসা খাঁর নাম প্রথমে আসে। ব্রহ্মণবাড়িয়া-ময়মনসিংহের জায়গীর ঈসা খাঁর রাজধানীও ছিল এই সোনারগাঁও। কেউ কেউ বলেন, ঈসা খাঁর স্ত্রী সোনাবিবির নামানুসারে এই প্রাচীন রাজধানীটির নাম হয়েছে সোনারগাঁও। শিল্পকলা, সংস্কৃতি ও সাহিত্যের দিক থেকে সোনারগাঁও ভারত বর্ষে বাংলাদেশ অংশে একটি গৌরবময় প্রাচীন জনপদ। বর্তমানে সোনারগাঁও পূর্বে মেঘনা, পশ্চিমে শীতলক্ষ্যা, দক্ষিণে ধলেশ্বরী ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বেষ্টিত নারায়ণগঞ্জ জেলার একটি উপজেলা ।
বর্তমানকার সোনারগাঁওয়ের প্রাচীন নাম ছিল সুবর্ণগ্রাম বা সুবর্ণভূমি। পূর্বে মেঘনা ও উত্তরে ব্রহ্মপুত্র নদী থাকাতে বাবসাবাণিজ্য প্রসারে এই এলাকাটি ছিল উন্নত একটি নদী বন্দর । মেঘনার মোহনা দিয়ে বঙ্গোপসাগরে বড় বড় নৌকা বা জাহাজ দিয়ে বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ করতে ও রাষ্ট্র পরিচালনার কৌশলগত দিক হতে এই সুবর্ণগ্রাম এলাকাটি ছিল সে যুগে রাজা বাদশাদের কাছে অতি আকর্ষণীয় গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যাবসায়িক ও প্রশাসনিক এলাকা ।

জোর যার, মুল্লুক তার: সর্বযুগের রাজা বাদশাদের অনুসৃত নীতির সাক্ষী সোনারগাঁ

একটা ব্যাপার সর্ব যুগে সর্ব সমাজে বাস্তব ছিল। তা হলো, জোর করে পরের সম্পদ দখল করা - যদি সেটা দখল করলে দখলকারীর লাভ হয়। এক্ষেত্রে দখলকারীকে অবশ্যই দখলহারা ব্যাক্তির চাইতে অধিক শক্তিশালী হতে হবে। এ কারণেই সে যুগের রাজা বাদশারা - এমনকি জমিদাররা শক্তিশালী সেনাবাহিনী গড়ে তুলতো। যে রাজার যত বড় এবং অধিক শক্তিশালী সৈন্যসামন্ত থাকতো, সে রাজাকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল রাজারা ভয় করতো। বড় রাজা বা সম্রাটকে ছোট রাজাদের কর দিতে হতো। না দিলে বড় রাজা ছোট রাজার রাজ্য দখল করে ফেলতো। কৌশলগত কারণে ওই রাজাদের দুর্গ থাকতে হতো এমন জায়গায় - যেটা নিরাপদ এবং যেখান থেকে শত্রুপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য সেনাবাহিকে উপযুক্ত করে তৈরী করা যায়। আর রাজ্য শাসন, কর সংগ্রহ, রাজ্যের উন্নতি ও ব্যবসাবাণিজ্য সম্প্রসারণে রাজ্যের রাজধানী হতে হবে এমন জায়গায় যেখান হতে রাজা বা সম্রাটরা সবকিছুই নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। প্রাচীন সুবর্ণ গ্রাম এলাকাটি ছিল এমনি একটি জনপদ। তবে সে যুগে বর্তমানকার মতো কোনো এলাকাতেই এতো জনবসতি ছিল না। একারণে সে যুগের জনপদ বা শহরগুলো ছিল বর্তমানকার জনপদ ও শহরের চাইতে অনেক ছোট। সোনারগাঁওয়ের পানামনগর ছিল তেমনি একটি সেকালের অনিন্দ সুন্দর তিলোত্তমা শহর।   

সুলতানি আমলের পূর্বে সোনারগাঁওয়ের শাসক কারা ছিল?

আদি যুগে সুবর্ণগ্রামটি ছিল ভ্যানগা (Vanga), সেন (Sena) ও দেব (Deva) বংশের রাজাদের প্রশাসনিক আখড়াস্থল। এই রাজাদের আগের কোনো রাজাদের সম্পর্কে ঐতিহাসিক তেমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়না। ভ্যানগা সাম্রাজ্যের মেয়াদকাল ছিল খ্রিস্ট পূর্ব এগারোশো সালে। আর সেন ও দেব সাম্রাজ্যের রাজত্ব ছিল একাদশ হতে ত্রয়োদশ শতাব্দীতে। সোনারগাঁ তথা সুবর্ণগ্রামে এই তিন সাম্রাজ্যের প্রশাসনিক হাব বা রাজধানী থাকার প্রমান ইতিহাসে পাওয়া যায়।
তবে ইতিহাস বলে যে দেব সাম্রাজ্যের রাজা দশরথদেব ত্রয়োদশ শতাব্দীতে তার রাজধানী বিক্রমপুর হতে সুবর্ণভূমি বা সুবর্ণগ্রামে স্থানান্তর করেন। অর্থাৎ সুবর্ণগ্রাম রাজধানী হিসেবে ব্যাবহারিত হয় দেব সাম্রাজ্যের রাজাদের দ্বারা। যদিও মধ্য যুগে মুসলিম শাসকরা এই সুবর্ণগ্রামকে তাদের রাজধানী হিসেবে উন্নত করেন - যেটি সে যুগে ভারতীয় উপমহাদেশ ও দক্ষিণ এশিয়ায় পূর্ব বাংলার শিল্প সংস্কৃতি, ব্যবসা বাণিজ্য ও প্রশাসনিক কেন্দ্র হিসেবে পূর্ববাংলার প্রতিনিধিত্ব করতো।
সেকালে ভারত বর্ষের বাংলাভাষাভাষী অঞ্চলগুলোর একেক অঞ্চল একেক রাজা দ্বারা শাসিত হতো। সোনারগাঁও পূর্ববঙ্গের আওতাধীন বিভিন্ন রাজাদের দ্বারা বিভিন্ন সময়ে শাসিত হয়েছিল। এই রাজা বা সম্রাটরা কেউ ছিল দেশীয়, আবার কেউ ছিল বিদেশী। যেমন তুর্কি, ইরানি, আফগানী এবং ইংরেজ।
এখানে আরো একটি কথা বলে রাখি, সেকালে বর্তমানকালের মতো কোনো রাষ্ট্র সংঘ ছিল না। ভারতবর্ষের একেক অংশ একেক রাজা বা জমিদাররা শাসন করতো। একই সময়ে একাধিক রাজা বাদশারা একেক অঞ্চল শাসন করতো। রাজাদের মধ্যে যুদ্ধ ও রাজ্য দখল ছিল একটি নিয়মিত ব্যাপার। ফলে কোনো রাজ্য বা সাম্রাজ্যের স্থায়ী কোনো নির্দিষ্ট সীমারেখা বা চৌহদ্দি ছিল না। তবে সম্রাট ও সুলতানদের কর্তৃক শাসিত রাষ্ট্রগুলো ছিল অনেক বড় যাদের আওতায় কয়েকজন রাজা বা জমিদার থাকতো - যারা সম্রাট বা সুলতানদেরকে বাৎসরিক কর প্রদান করতো।
এবার আমরা ইতিহাসের সময়কালকে সংক্ষেপ করে সোনারগাঁওয়ের গৌরবগাথা বর্ণনা করবো। সোনার গায়ের সঠিক ও আধুনিক ইতিহাস পাবো দেব সাম্রাজ্য হতে।
সোনারগাঁওয়ের শাসনকালকে মোটামুটি পাঁচটি সময়কালে ভাগ করা যায়।
প্রথম ভাগে: আদি কাল। যেমন Vanga, সেন, দেব, পাল ইত্যাদি। এই শাসনামল ছিল খ্রিস্ট পূর্ব দ্বাদশ শতাব্দী হতে খ্রিস্টের জন্মের ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দশক পর্যন্ত।
দ্বিতীয় ভাগে আসে দিল্লির সুলতানদের শাসন যা খিলজি সাম্রাজ্যের মাধ্যমে সূচিত হয়ে শেষ হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর প্রথম দিকে ।

সুলতানি আমল:সোনারগাঁওয়ের প্রসিদ্ধির সোনালী সময় 

এবার আসুন সোনারগাঁওয়ের গৌরবময় আমলের গৌরবগাথা শুনি যে কারণে বাঙালি মুসলিম হিসেবে আমরা নিজেদেরকে গৌরবগাঁথার অংশ করে নিতে পারি। সোনারগাঁওয়ের এই তৃতীয় ভাগে সোনারগাঁওয়ে স্বাধীন সুলতানদের শাসন শুরু হয়। দিল্লির তুঘলক সাম্রাজ্যের সময়ে ফখরুদ্দিন মোবারাক শাহ দিল্লির শাসনের বিরুদ্ধে এসে নিজেকে পূর্ব বাংলার স্বাধীন সুলতান বলে ঘোষণা করেন। এই সুলতানি আমলের প্রতিষ্ঠা লাভের মাদ্ধমে সোনারগাঁওয়ে স্বাধীন সুলতানদের শাসন শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে। তবে বাংলার অন্য একটি রাজ্য সাতগাঁওয়ের শাসক শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ ১৩৫২ সালে সোনারগাঁওয়ের স্বাধীন সুলতান ফখরুদ্দিন মোবারাক শাহ এর পুত্র ইখতিয়ারউদ্দিন গাজী শাহকে পরাজিত করে সোনারগাঁওয়ে বাংলা সুলতানি আমলের প্রতিষ্ঠা করেন। এই বাংলা সুলতানি আমলের তৃতীয় সুলতান গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের আমলে সোনারগাঁওয়ের যশ ও প্রসিদ্ধি বিশ্বময় ছড়িয়ে পরে। মধ্যযুগের বাংলায় এটি ছিল একটি মুসলিম স্বাধীন রাষ্ট্র।
এই বাংলা সুলতানি আমলে গিয়াসুদ্দিন আজম শাহের সময়ে সোনারগাঁওয়ে একটি রাজসভা ও বিচারালয় প্রতিষ্ঠিত হয় - যেখানে দেশি বিদেশী কবি লেখক, বিচারক ও উকিল মোক্তারদের কর্মচাঞ্চল্লে সোনারগাঁও সালতানাত মুখরিত হয়ে উঠে। এই বাঙালি সুলতানদের সময়কালেই সোনারগাঁওয়ে আগমন ঘটে বিখ্যাত পারস্য কবি হাফিজের, সে সময়েই সোনারগাঁওয়ে গড়ে উঠে সেকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মসলিন বস্ত্র শিল্প, তৈরী হয় আধুনিক শহর, সুরম্য দালান কোঠা, উন্নত রাস্তা ঘাট, হাট বাজার ও সুদৃশ্য সরোবর। এই শাসনামলেই সোনারগাঁও হয়ে উঠে মুসলিম সুফী সাধকদের ধর্মীয় শিক্ষার একটি কেন্দ্রবিন্দু যা ছিল ভারত বর্ষের ইসলামী শিক্ষার অন্যতম একটি মিলন মেলা।
এখানে উল্লেখ্য, ইলিয়াস শাহের পূর্বপুরুষরা ইরানের সিজিস্থান প্রদেশের অধিবাসী ছিল। আরো একটি কথা এখানে বলা প্রয়োজন, ফখরুদ্দিন মোবারাক শাহ ও শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ যে সোনারগাঁওয়ে স্বাধীন সাম্রাজ্য প্ৰতিষ্ঠা করেন, তার মানে হলো তাদের শাসিত এলাকা ছিল দিল্লির সুলতানদের শাসন হতে স্বাধীন।
১৪৯৪ সালে আলাউদ্দিন হুসাইন শাহ বাংলার মসনদ দখল করেন এবং হোসেইন শাহী সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন। এই হোসাইন শাহী সাম্রাজ্যের সময়ে গিয়াসুদ্দিন মাহমুদ শাহের আমলে সোনারগাঁওয়ে বাংলার স্বাধীন সুলতানদের শাসনের সমাপ্তি হয়। সোনাগাঁও চলে যায় আফগান, তথা সুর ও কররানী সাম্রাজ্যের অধীনে । কররানী শাসনের আমলে ঈসা খান ছিলেন রাজ্ খান কররানীর প্রধানমন্ত্রী। আফগান সম্রাট শেরশাহের আমলে বিখ্যাত গ্রান্ড ট্রাঙ্ক রোড সোনারগাঁও পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। আফগানদের শাসন শুরু হয় ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে।
একটি ব্যাপার এভাবে প্রতিষ্ঠিত যে সোনারগাঁও হলো ঈসা খাঁর রাজধানী। তাহলে আসুন আমরা এবার ঈসা খাঁর সম্মন্ধে আলোচনা করি। আগেই বলে রাখি ঈসা খাঁ ছিলেন খাঁটি বাঙালি। বাংলায় কররানী বংশের পতনের শেষভাগে পূর্ব বাংলায় স্বাধীন বারো ভূঁইয়াদের শাসন শুরু হয়।

ঈসাখাঁর সোনারগাঁও 

সুর বংশের পর বাংলার শাসন চলে যায় আফগান উপজাতি কররানী বংশের কাছে। ঈসা খাঁ ছিলেন কররানী সুলতান তাজখান কররানীর প্রধান মন্ত্রী। তাজখান কররানীর কাছ হতে ঈসা খান ১৫৬৪ সালে সোনারগাঁওয়ের জায়গীর লাভ করেন। এই সময়টা মোঘলদের সাথে কররানী সাম্রাজ্যের সম্রাটদের যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই থাকতো। সে সময়ে প্রাচীন বাংলা ও আসামে কয়েকজন জমিদার স্বাধীনভাবে কয়েকটি এলাকা শাসন করতো। এরা ভূইয়াঁ নামে পরিচিত ছিল। মোঘলদের কাছ থেকে সোনারগাঁওকে রক্ষা করতে ঈসা খাঁর নেতৃত্বে বাংলার বারো ভুঁইয়ারা সংগঠিত হয় এবং মোঘলদের সাথে যুদ্ধ করে। ১৫৭৫ সালে বাংলার স্বাধীন সুলতান দাউদ খান কররানী রাজমহলের যুদ্ধে দিল্লির সম্রাট আকবরের সেনাদের কাছে পরাজিত হলে বাংলায় স্বাধীন সুলতানদের শাসনের পতন হয়। তবে বিচ্ছিন্ন ভাবে হলেও সোনারগাঁওয়ের বারো ভুঁইয়ারা দিল্লির শাসনকে মেনে না নিয়ে স্বাধীনভাবে বাংলায় তাদের রাজ্য চালাতে থাকে। ১৫৯৭ সালে ঈসা খান রাজমহলের একটি যুদ্ধে মোঘলদের পরাজিত করেন। তবে যুদ্ধে মোঘলদের পরাজিত করলেও ঈসাখাঁ ভবিষ্যতে সোনারগাঁওয়ের টেকসই শান্তি-শৃঙ্খলা বিধানের লক্ষ্যে মোঘলদের সাথে মোঘল সম্রাট আকবরের সাথে একটি শান্তি চুক্তিতে আবদ্ধ হন । মোঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে সুবে বাংলার সুবেদার ইসলাম খানের আমলে সোনারগাঁও হতে পূর্ব বাংলার রাজধানী ঢাকাতে স্থানান্তরিত হলে ঐতিহাসিক সোনারগাঁও তার গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।


সোনারগাঁওয়ের পানাম নগর ও মসলিন বস্ত্রের  গৌরবগাঁথা
এবারে আসুন সোনারগাঁওয়ের পানাম নগর ও মসলিন বস্ত্রের গৌরবগাঁথার বিবরণ আমরা শুনি। তবে তা হবে খুবই সংক্ষেপে।
প্রাচীন গ্রীক ও রোমান সূত্রমতে প্রাচীনকালে এই সোনারগাঁওয়ের সাথে সংযুক্ত ছিল একটি শিল্প বাণিজ্যের সাজানো শহর যেটির নাম ছিল পানাম নগর। প্রত্নতাত্ত্বিকদের ধারণা, বর্তমানকার নরসিংদী জেলার মাটির নিচে চাপা পড়া প্রাচীন শহর ওয়ারী-বটেশ্বরের সাথে এই পানাম নগরীর সংযোগও ছিল। পানাম নগরের ভবনগুলি ছোট ছোট লাল ইট দিয়ে নির্মিত ছিল, যেগুলো বর্তমানে প্রায় ধ্বংসপ্রায়। চারশত বছরের পুরোনো পানামনগরের অধিকাংশ ভবনগুলি আয়তাকার এবং উত্তর-দক্ষিণে বিস্তৃত। একটি দীর্ঘ সড়কের উভয় পাশে নির্মিত বায়ান্নটি এক ও দ্বিতল ভবন গুচ্ছ দিয়ে এই পানাম নগরের অবস্থান। সেকালের সেরা সেরা স্থাপত্য কৌশল ও শিল্প কলার সমন্বয়ের মাধ্যমে এই পানাম নগরের পত্তন হয়েছিল। এই ছোট নগরের প্রধান আকর্ষণ হলো ৫২টি সুরম্য অট্টালিকা - যেগুলোর মালিক ছিল বস্ত্র ব্যাবসায়ী ধনি বণিকগণ। এখানে উল্লেখ্য যে বাংলার গৌরব মসলিন শিল্প এই পানাম নগরীকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছিল।
কথিত আছে যে ইংল্যান্ডে বস্ত্র শিল্পের পসার বৃদ্ধি করতে ইংরেজরা সোনারগাঁওয়ের মসলিন কাপড়ের কারিগরদের আঙ্গুল কেটে দেয় এবং মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করে ফেলে। উল্লেখ্য, মসলিন কাপড় খুবই পাতলা ও মসৃন ছিল। সেকালের একটি মসলিন শাড়িকে অনায়াসে একটি আংটির ভেতর দিয়ে এপার ওপর করা যেত। এমনকি মসলিন সুতা দিয়ে তৈরী একটি শাড়িকে অনায়াসে একটি দেশলাইয়ের বাক্সে ভরে রাখা যেত। বর্তমানকার গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া অঞ্চলে উৎপাদিত বিশেষ ধরণের কার্পাস তুলা থেকে মসলিন কাপড়ের সুতা তৈরী হতো। অনেক দাম হওয়াতে এই মসলিন কাপড় সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে ছিল। শুধু মাত্র ধনি ও রাজা বাদশারা এই মসলিনের তৈরী পোশাক ব্যবহার করতো। সেকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সোনারগাঁওয়ের মসলিন সামগ্রী রপ্তানি হতো। এই মসলিন শিল্পকে কেন্দ্র করেই পানাম নগরীর বণিক পাড়া গড়ে উঠেছিল। পরের আর একটি ভিডিওতে আমরা সোনারগাঁওয়ের পানাম নগরীর ইতিহাস ও সোনালী অতীত নিয়ে আলোচনা করবো।

পানাম নগরে কি কি দেখবেন?  

বর্তমানে এই সোনারগাঁওয়ে রয়েছে পানাম নগরের ঠাকুরবাড়ি এবং ঈশা খাঁ'র তোরণ মিলিয়ে প্রায় ষোল হেক্টর এলাকায় লোকশিল্প ও কারুশিল্প ফাউন্ডেশন স্থাপনা। এখানে একটি জাদুঘর, একটি লোকজ মঞ্চ, সেমিনার কক্ষ, এবং একটি কারুশিল্প গ্রাম দর্শনার্থীদের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। জাদুঘরে প্রায় চার হাজার নিদর্শন সংরক্ষিত রয়েছে। প্রতি শুক্রবার হতে বুধবার সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য জাদুঘর খোলা থাকে। তবে, শুক্রবারে দুপুর ১২টা থেকে দুপুর ২টা পর্যন্ত জুমার নামাজের জন্য জাদুঘর বন্ধ থাকে। পরেরদিকের আর একটি ভিডিওতে আমরা জাদুঘরের সংরক্ষিত সামগ্রীগুলো দেখবো এবং প্রাচীন সে সামগ্রীর ব্যাবহারকারীদের সম্মন্ধে আলোচনা করবো।
পানাম নগরের প্রবেশ মূল্য প্রতিজনে ১৫ টাকা এবং এই সুদর্শন নগরীর পার্শে মনোরম লেকে আপনার জন্য অপেক্ষমান থাকবে কারুকার্যখচিত সুন্দর সুন্দর স্পীডবোট ও বাজরা - যেগুলো ব্যবহার করে আপনি সপরিবারে নীল লেকের স্বচ্ছ সরোবরে ভাসতে পারবেন স্বাচ্ছন্দ চিত্তে। তবে এই স্পীডবোট ও বাজরা গুলোর প্রতিটি একবার ব্যবহার করতে প্রতিঘন্টায় আপনাকে গুনতে হবে দুই শত টাকার উপরে।
বাংলাদেশের ঐতিহাসিক স্থানগুলো পরিদর্শন করুন ও নিজেকে আনন্দিতও ও গৌরবান্বিত বোধ করুন।
আজ তাহলে এপর্যন্তই। 
শুভেচ্ছা নিরন্তর।

সোনারগাঁওয়ে নিয়ে নির্মিত ভিডিওটি দেখুন




.......................................................................

সোনারগাঁকে নিয়ে শব্দমালা

#সোনারগাঁও #সোনারগাঁওর_ইতিহাস #বাংলা সুলতানী আমল চিসরা #চিসরা_চ্যানেল #চিত্তকে_সন্তুষ্ট_রাখুন_Keep_Soul_Delightful
Sonargaon Museum,Bengal Sultanate,Goaldi Mosque,Sonargaon Folk Arts and Crafts Museum,Panam City Sonargaon,সোনারগাঁওর ভ্রমণ,sonargaon museum narayanganj,panam city sonargaon,goaldi mosque,story of goaldi mosque,historical goaldi mosque,goaldi mosque sonargaon,renwick gallery,sonargaon museum,sonargaon narayanganj,sonargaon folk arts and crafts museum,sonargaon folk art and craft museum,sonargaon royal resort,sonargaon purbapara,পানাম নগর,panam nagar,panam city sonargaon bangladesh,সোনারগাঁও লোকশিল্প জাদুঘর,একদিনে সোনারগাঁও ভ্রমণ,goaldi mosque narayanganj সোনারগাঁও এর দর্শনীয় স্থান সোনারগাঁও সম্পর্কে তথ্য সোনারগাঁও এর ইতিহাস সোনারগাঁও কি জন্য বিখ্যাত সোনারগাঁও কোন জেলায় অবস্থিত সোনারগাঁও এর পূর্ব নাম কি সোনারগাঁও সম্পর্কে অনুচ্ছেদ সোনারগাঁও উপজেলার ইউনিয়নের নাম

No comments

Powered by Blogger.