Header Ads

সোনারগাঁওয়ে মসলিন-শিল্পকেন্দ্রিক প্রাচীন শহর পানাম নগর



সোনারগাঁওয়ে মসলিন-শিল্পকেন্দ্রিক প্রাচীন শহর পানাম নগর

কেন পানাম নগরী বিখ্যাত? 

প্রিয় দর্শক আপনার কি সাধ জাগে না?- হাজার বছর আগেকার বাংলাদেশের একটি প্রাচীন নগরী দেখতে? যেটিতে সে কালের সবচাইতে ধনী লোকরা বসবাস করতো? ইউরোপীয়,মোঘল ও ভারতীয় শিল্পকলা সংমিশ্রিত ভাস্কর্য্য প্রয়োগ করে নির্মিত হয়েছিল এই নগরীর সবগুলো বাড়ি। কোনটি একতলা, কোনটি দোতলা আবার কোনটি তিনতলা। পনেরো ফুট চওড়া রাস্তার দুপাশের এই সুরম্য অট্টালিকাগুলো সজ্জিত হয়েছিল প্রায় দুশো ফুট লম্বা রাস্তার দুপাশ জুড়ে। বাইরের সাথে চলাচলের জন্য ছিল ঘোড়ার গাড়ি, বাড়ির ভেতরে ছিল পারিবারিক আড্ডা দেয়া ও পূজা অর্চনা করার জন্য নিকোনো উঠান, সুরক্ষার জন্য ছিল চারদিকে উঁচু পাকা দেয়াল, ছিল আধুনিক নাগরিক সকল সুযোগ সুবিধা। ছিল উন্নত পানি সরবরাহ ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা। শহরটিকে নিরাপদ রাখতে খনন করা হয়েছিল শহরের চার দিকে সুগভীর লেক। বাইরের সাথে যোগাযোগগের জন্য ছিল আধুনিক সব রাস্তা ঘাট। সেকালের একটি আধুনিক শহরের সকল নাগরিক সুযোগ সুবিধাই ছিল অনিন্দ সুন্দর ছোট্ট ঐ নগরীতে। দেশীয় চুন সুরকির তৈরী এই চিত্ত হরণকারী অট্টালিকাগুলো সাজাতে বিদেশ থেকে আনা হয়েছিল ঢালাই লোহার তৈরী কারুকার্য খচিত গেইট, বারান্দার রেলিং, উপরে উঠার সিঁড়ি ও মূলকাঠমোর বীম ও পিলার। অট্টালিকার ভেতরটা সাজানোর জন্য বিদেশ হতে আনা হতো দামি সব পাথর ও আসবাবপত্র। যেমন তেমন নগরী ছিলোনা এই পানাম নগরী বা পানাম সিটি । কেবলমাত্র বাংলাদেশের সবচাইতে ধনী লোকরাই পারতো এই নগরীতে বসবাস করতে। এরা ছিল বস্ত্র ব্যাবসায়ী। কিসের বস্ত্র জানেন? মসলিন সুতা দিয়ে বানানো খাসা ও জামদানি কাপড়ের ব্যবসা। যেগুলো রপ্তানি হতো সেকালের অনেক অনেক দেশে। সে সময়ে মসলিন সুতার তৈরী কাপড় দেশ-বিদেশের রাজা বাদশাদের কাছে অতি লোভনীয় সামগ্রী ছিল। উচ্চমূল্যে তারা বাংলাদেশের ব্যাবসায়ীদের কাছ থেকে এগুলো কিনে নিতো। প্রাচীন এই পানাম নগরীটি সারা বিশ্বে এতই বিখ্যাত ছিল যে বিশ্বের নামকরা পর্যটক - যেমন চীনের মা হুয়ান, মরোক্কোর ইব্ন বতুতা, ব্রিটিশ রাল্ফ ফিচ এবং ইতালিয়ান নিকোলো দে কোন্টি এই শহরটি পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। 



পানাম নগরীর পত্তন কখন?

আজকে আপনাদেরকে নিয়ে যাবো সেই প্রসিদ্ধ প্রাচীন নগরী পানামে - যেখানে দেখবেন ঐ ছোট্ট সুন্দর শহরটিকে। দেখে দেখে শুধু আপনার দু চোখই জুড়াবে না, ঐ পানাম সিটির নির্মাণ শৈলী, অবকাঠামো, ও আন্ত ও বাহির সৌন্ধৰ্য দেখে আপনি মুগ্ধ না হয়ে পারবেন না। আপনি আশ্চার্য্যও হয়ে যাবেন।  এই পানাম নগরীটির পত্তন হয় বাংলাদেশের প্রাচীন রাজধানী সোনারগাঁওয়ে। কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে রাজা দনুজামাধব দশরথদেব বিক্রমপুর হতে সুবর্ণগ্রামে তার রাজধানী স্থানান্তর করলেও ত্রয়োদশ শতাব্দীর পূর্বেই দেব সাম্রাজ্যের রাজাদের দ্বারা কোনো এক সময়ে বর্তমানকার সোনারগাঁওতে পানাম নগরীর পত্তন হয়, যা পরবর্তীকালে ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগে মুসলিম সুলতানদের কর্তৃক বিকশিত হয়। আরো পরে ব্রিটিশ যুগে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে আজকের আলোচিত পানাম নগরী তথা বস্ত্র-নগরী বস্ত্রব্যাবসায়ীদের দ্বারা পূর্ণতা পায়। নির্মাণ শৈলী ও রূপ মাধুর্য্যের বিচারে পানাম নগর সেকালে সারা বিশ্বের গৌরবজনক অন্যতম একটি আধুনিক শহরের তালিকায় স্থান করে নেয়। 



প্রাচীনকালে সোনারগাঁও কেন এতো গুরুত্বপূর্ণ ছিল?

সোনারগাঁও নামটি এসেছে তেরো শতাব্দীর প্রথম-ভাগে প্রতিষ্ঠিত দেব বংশের রাজধানী সুবর্ণগ্রাম হতে। মধ্য যুগের সুলতানি আমলে সুবর্ণগ্রামটিকে মুসলিম শাসকরা সোনারগাঁও নামকরণ করেন । বাংলার স্বাধীন মুসলিম সুলতানরাই সোনারগাঁওকে পূর্ব বাংলার ব্যবসা বানিজ্য ও প্রশাসনিক কর্মকান্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে উন্নীত করেন। সেকালে রাজধানী সোনারগাঁওয়ের তিন দিকটাই ছিল মেঘনা, ব্রহ্মপুত্র ও শীতলক্ষ্যা নদী দ্বারা পরিবেষ্টিত। যে কারণে নৌযান-প্রধান মধ্য যুগে এই সোনারগাঁও ছিল রাজা বাদশাদের একটি আদর্শ রাজধানী। বাংলার স্বাধীন সুলতানি আমলে ও ঈশা খাঁর আমলে এই সোনাগাঁও ছিল বাংলাদেশের রাজধানী। পরবর্তী কালে পঞ্চদশ শতাব্দীতে সোনারগাঁও মোঘলদের শাসনে এলে মোঘলরা এই সোনারগাঁওকে বাংলার মসলিন শিল্পের একটি উন্নত ব্যবসা কেন্দ্রে পরিণত করেন। ইরান থেকে প্রশিক্ষক এনে মসলিন শিল্পের কারিগরদেরকে প্রশিক্ষিত করেন। পরবর্তীকালে মোঘলদের কাছ থেকে সোনারগাঁও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির দখলে গেলে ব্রিটিশরা বিদেশে মসলিন কাপড় রপ্তানি করে অধিক লাভ করার জন্য সোনারগাঁওয়ে অনেক অনেক বিনিয়োগ করে। ইতিহাস হতে জানা যায়, সেকালে সোনারগাঁওয়ে চৌদ্দশত কারিগর-পরিবার এই মসলিন কাপড় বুনার কাজে নিয়োজিত ছিল। 



কারা পানাম নগরীর অধিবাসী ছিল?

মসলিন বস্ত্র ব্যবসা অধিক লাভজনক হওয়াতে সেকালে ভারতীয় উপমহাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত হতে ব্যাবসায়ীরা ব্যাবসায়িক উদ্দেশ্যে সোনাগাঁওয়ে এসে বসবাস করতে থাকে। এই ধনী ব্যবসায়ীরাই সোনারগাঁয়ের পানাম এলাকায় পরবর্তীকালে তাদের বসবাসের জন্য এই সুরম্য প্রাসাদগুলো তৈরী করে, যেগুলো সম্মিলিত ভাবে আধুনিক ও বিলাসী পানাম নগরীর পত্তন করে। তবে ইতিহাস হতে জানা যায় যে, এই পানাম নগরীর পত্তন শুরু হয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর শেষভাগের স্বাধীন সুলতানি আমল হতে যা পরবর্তী কালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির যুগে চূড়ান্ত একটি শহরের মর্যাদায় পরিপূর্ণতা লাভ করে। 



ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে মসলিন শিল্প কেন এতো আকর্ষণীয় মনে হয়েছিল?

১৭৮৯ সালের ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির একটি রিপোর্ট হতে জানা যায় যে সে সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির রপ্তানি বাণিজ্যের পঁচাত্তর ভাগই আসতো মসলিন কাপড় রপ্তানি খাত হতে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে খাস নামক মসলিন কাপড়ের চাহিদা সারা বিশ্বেই তুঙ্গে ছিল। মসলিনের তৈরী জামদানির জন্যও সোনারগাঁও সারা বিশ্বে বিখ্যাত ছিল। 



পানাম নগরীর নির্মাণ শৈলীর বিশেষত্ব কী?

২০০৬ সালের এক গবেষণায় আহসানুল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক সিরাজুম মুনিরা খন্দকারের মতে এই পানাম নগরীর ভবনগুলোকে নির্মাণশৈলীর দিক থেকে চারটি শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। এক: উন্মুক্ত উঠান কেন্দ্রিক - যার চারদিকে আয়তাকার কাঠামোতে ভবনের প্রয়োজনীয় কক্ষসমূহ বিন্যস্ত ছিল। দুই: আবৃত কেন্দ্রীয় সভাকক্ষ কেন্দ্রিক - যার চার দিকে বসবাসের কক্ষসমূহ বিন্যস্ত ছিল। তিন: লাগোয়া কক্ষ বিশিষ্ট - যেখানে একটি করিডোরের দুপাশে বসবাসের কক্ষসমূহ বিন্যস্ত ছিল এবং চার: এক বা বহু কক্ষবিশিষ্ট যেগুলো ছিল বসবাসের জন্য বা গুদাম হিসেবে ব্যাবহারের জন্য সাধারণ ভবন। সবগুলো ভবনের মাঝে দ্বিতল কাশীনাথ ভবনটি ছিল সবচাইতে অলংকৃত সুন্দরতম ভবন - যেটি পানামনগরের সবচাইতে ধনী ব্যাবসায়ী কাশীনাথ বাবু বাংলা ১৩০৫ তথা ইংরেজি ১৮৯৯ সালে নির্মাণ করেছিলেন। 



পানাম নগরীর কাশীনাথ মন্দির

কাশীনাথ মন্দির নামে পানাম নগরীতে একটি মন্দিরও রয়েছে, যেটিতে এখনো পূজা অর্চনার আয়োজন চালু রয়েছে। পানাম নগরীর বেশিরভাগ অট্টালিকার মেঝে সাদা ও কালো মার্বেল পাথর দিয়ে তৈরী করা হয়েছিল। আর অনেক ভবনের প্রবেশ দ্বার গোল বা চারকোনা পিলারের উপর রঙিন টাইলস দ্বারা নকশা করা - যা এখনো দর্শকদের মন কেড়ে নেয়ার সামর্থ রাখে। কোনো এক সময়ে পানাম নগরীতে ভবনের সংখ্যা ষাট থাকলেও ধ্বংস হতে হতে বর্তমানে তা বায়ান্নতে এসে থেমেছে - যেগুলো আজও পানাম নগরীর প্রাচীন গৌরব ও শৌর্য বীর্যকে স্মরণ করিয়ে দেয়।




ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কেন পানাম নগরীর মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করে?

পানাম নগরে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মসলিন-শিল্প কেন্দ্রিক ব্যবসা জমজমাট থাকলেও একসময়ে ইংল্যান্ডের বস্ত্রশিল্পের জন্য নীল রঙের চাহিদা বেড়ে যায়। ইংরেজরা দেখলো, ইংল্যান্ডের রং শিল্পকে সমৃদ্ধ করার জন্য তাদের কাঁচামালের প্রয়োজন। সেকালে নীল গাছ হতে নীল রং তৈরী করা হতো। আর ইংল্যান্ডে এই নীল গাছের যোগান বাড়াতে তারা বাংলাদেশের মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন তারা এই মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করার জন্য মসলিন-সুতা কাটার কারিগরদের হাত কেটে দেয় এবং যে গাছ হতে মসলিন সুতা পাওয়া যেত, সে পুটি-কার্পাস তুলা উৎপাদনকারী চাষীদেরকে নীল চাষ করতে বাধ্য করলো।  বর্তমানকার গাজীপুরের কাপাসিয়া এলাকায় ঐ পুটি কার্পাস তুলার ব্যাপক চাষ হতো। ঐ কার্পাস হতেই ঐ এলাকার নাম কাপাসিয়া হয়েছে। 





পানাম নগরীর গুরুত্ব কেন ও কবে থেকে কমতে থাকে?

সোনারগাঁওয়ে মসলিন কাপড়ের ব্যবসা বন্ধ হয়ে গেলে ধনী ব্যাবসায়ীদের অনেকেই পানাম নগরী ত্যাগ করে অন্যত্র চলে যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আরো কিছু ব্যাবসায়ী পানাম নগরী হতে তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলে। পরবর্তীকালে ১৯৪৭ সালে উপমহাদেশের বিভাজনের সময়ে হিন্দু মুসলিম দাঙ্গার কারণে বাকি ব্যাবসায়ী বা তাদের উত্তরসূরিরা সোনারগাঁও ছেড়ে ভারতে চলে যায়। কোন কোনো ঐতিহাসিকের মতে ১৯৪৭ সালে কে বা কারা সুদৃশ্য এই মনোরম নগরীতে রাতের আঁধারে আগুন ধরিয়ে দেয়। এতে এই নগরীটি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। নগরীর অধিবাসীদের  অনেকেই আগুনে পুড়ে মারা যায়। বাকি যারা বেঁচে ছিলেন, তারাও পরবর্তীকালে এই নগরী ছেড়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে প্রত্যাবাসিত হয়। এভাবে এককালের সমৃদ্ধ তিলোত্তমা পানাম নগরী জনশূন্য হয়ে পড়ে এবং মহা কালের পরিক্রমায় সংরক্ষণ মেরামতহীনতার কারণে অতীতের সুরম্য অট্টালিকাসমৃদ্ধ পানামনগরী আজ একটি ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হয়েছে


ধ্বংশধারার আবর্তের  মধ্যেও কেন  পানাম আজও এতো আকর্ষণীয়?

অতীতের তিলোত্তমা পানাম নগরী একটি ভুতুড়ে নগরীতে পরিণত হলেও  আপনি যদি এই শহরটিতে একবার ঢুকে এবং খুব কাছ হতে এই নগরীর অট্টালিকাগুলো দেখেন, তা হলে এই ধ্বংসপ্রাপ্ত অট্টালিকাগুলোর মাঝেই আপনি খুঁজে নিতে পারবেন ধনী বস্ত্র ব্যাবসায়ীদের শৌর্য-বীর্য প্রতাপের সোনালী যুগটিকে। অট্টালিকারগুলোর নির্মাণ শৈলী, অলংকরণ-সৌন্ধর্য নাগরিক সুবিধা সম্বলিত অবকাঠামোগুলো আপনাকে আশ্চর্য না করে পারবেন না। নগরীর প্রসশস্ত রাস্তাটি দিয়ে হাটতে হাটতে আপনারও মনে হবে, আপনিও বুঝি ছুটে চলছেন ঘোড়ার গাড়িতে চড়ে কোনো এক সমৃদ্ধ নগরীতে। যেখানে রাস্তার দুপাশে সাজানো রয়েছে মনোরম সব সুরম্য অট্টালিকা, বারান্দায় দাঁড়িয়ে আপনাকে অবিবাধন জানাচ্ছে ধনী বণিকদের পরিবারের সদস্যরা।



পানাম নগরী ধ্বংসের মূল কারণ কী শুধুই এটির বয়স বা স্থিতিকাল?


পানাম নগরীর অনেক ভবনকে সেকালে বস্ত্র ব্যাবসায়ীরা বস্ত্রের গুদাম হিসেবে ব্যবহার করতো।  দুর্বৃত্ত কর্তৃক পানাম নগরীতে সকল বস্ত্রের গুদামে  আগুন ধরিয়ে দিলে খুব সহজেই পুরো পানাম নগরী ধ্বংসপ্রাপ্ত হয় যা ক্রমান্বয়ে আরো ধ্বংস হতে হতে বর্তমানকার অবস্থায় এসে পৌঁছেছে । পৃথিবীর একশতটি ধ্বংসপ্রায় শহরের তালিকায় এই পানাম নগরী রয়েছে।


পানাম নগরীর উপর নির্মিত ভিডিওটি দেখতে নিচের ছবিটিতে ক্লিক করুন  




 

No comments

Powered by Blogger.